Sreemati Pratima Panja - Subir Banerjee

আমার প্রিয় শিক্ষিকা শ্রীমতি প্রতিমা পাঁজা


১৯৭৯ সালের এক শীতের সকাল। মায়ের হাত ধরে স্কুল বাসে করে এলাম এই লাল বাড়ি টার সামনে।। পরনে সাদা জামা সাদা হাফ প‍্যান্ট। বটলগ্রীন সোয়েটার। দরজার সামনে দাঁড়ানো একজন দিদিমনি মিষ্টি হেসে, আদর করে ভেতরে নিয়ে গেলেন। শুরু হলো আমার বড়ো স্কুলে পড়াশুনা। স্কুলের নাম নিউ আলিপুর বহুমুখী বিদ‍্যালয়। আর ঐ দিদিমনির নাম শ্রীমতী প্রতিমা পাঁজা। তাঁর অসাধারন ব‍্যক্তিত্ব, স্নিগ্ধ ব‍্যবহার এবং অবশ‍্য ই স্নেহ মিশ্রিত শাসন আমাকে অবাক করে দিলো। প্রাতঃকালীন বিভাগে থাকাকালীন অসম্ভব দুষ্টুমি করার জন‍্য উনি আমাকে একটি বিশেষ নাম দিয়েছিলেন। সেখান থেকে এলাম দিবা বিভাগে। তারপর যখন ই ওনার সাথে দেখা হয়েছে সেই বিশেষ নামে আমাকে ডেকেছেন। পুরনো দিনের মতো স্নেহ ঝরে পড়েছে আর তার সাথে ভালোবাসা মিশ্রিত শাসন। কালের নিয়মে স্কুল পেরিয়ে কলেজ। তারপর শুরু কর্মজীবন। স্মৃতির মণিকোঠায় ছিলো পুরনো সেই দিনগুলো। ভুলিনি কিছুই। তারপর নামসা র জন্ম আর সেই প্রথম দিন থেকেই নামসার সদস‍্য। 

একদিন ওঙ্কার দা'র সাথে কথা প্রসঙ্গে প্রতিমা দি'র ফোন নম্বর পেলাম।। ফোন করলাম। পরিচয় দিলাম আমি সুবীর ব‍্যানার্জী। ১৯৯০ মাধ‍্যমিক। সচরাচর এভাবেই পরিচয় দিয়ে থাকি।। উনি চিনতে পারলেন না। বললেন "বাবা আমার, মানিক আমার, তোকে চিনতে পারছি না রে"। হঠাৎ কি মনে হলো জানেন সেই যে আমাকে উনি একটা বিশেষ নাম দিয়েছিলেন সেই নাম টা বললাম। বিশ্বাস করুন একবারেই চিনতে পারলেন। আমার বিষয়ে অনেক কথা বললেন যা আমার জীবনের বিশেষ কিছু অধ‍্যায় । যেগুলো আমি আর উনি ছাড়া অনেকেই হয়তো জানে না।

দিদিমনি র দেওয়া সেই নাম টা কি জানেন ?? সেই নাম টা হলো "দুষ্টু"। যখন ই দেখা হতো এই নামে ডাকতেন।। কষ্ট হতো, অভিমান হতো।। ভাবতাম বন্ধুদের পোষাকি নামে ডাকেন আর আমাকে নামে !! কিন্তু এই ঘটনায় একটা কথা বুঝলাম মা মাসীমা রা তো আমাদের সেই নামে ই চেনেন যে নাম তাঁরা দিয়েছেন। তাই দিদিমনি আমাকে তাঁর দেওয়া নামেই মনে রেখেছেন। 

আমি গর্বিত ওনার দেওয়া এই নামের জন‍্য। আমি চিরদিন ওনার "দুষ্টু" হয়েই থাকবো।। ভালো থাকুন দিদিমনি।।

লেখক :: সুবীর ব‍্যানার্জী (মাধ‍্যমিক - ১৯৯০)
নিউ আলিপুর বহুমুখী বিদ‍্যালয়


Comments

Ranjan Sarkar said…
সুবীর খুব সুন্দর লিখেছ। এই সুত্রে আমার ও কিছু প্রাগৈতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি ফিরে এল। 1969 সাল। আমি তখন ক্লাস ফাইভ। স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণীতে প্রাথমিক বিভাগ থেকে নাটক হবে রবীন্দ্রনাথের কাবুলিওয়ালা। মুখ্য চরিত্র রহমত এর ভূমিকায় অভিনয় করার মতো কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার সহায় হোল আমার শারীরিক আকৃতি। আজকের মতো তখনও আমি ছিলাম দৈর্ঘ্যে প্রস্থে oversized । আমার আয়তনের জন্য বন্ধুদের থেকে চিরকাল মোটা ডাক শুনেছি। সেই আয়তন যে এমন দুর্লভ সুযোগ এনে দেবে স্বপনে ও ভাবিনি কোনোদিন। যাই হোক, casting তো হোল। তারপরেই বিড়ম্বনা শুরু হোল নাট্য পরিচালক প্রতিমাদির ও ওনার সহযোগি বুলবুল দি, প্রণতি দি ও অন্যান্যদের। পঞ্চাশ অধিক বছর পরে যদি কোনো দিদিমণির নাম বাদ পড়ে সে দায় সম্পূর্ণভাবে আমার স্মৃতি বিভ্রমের।

ওনাদের বিপুল পরিশ্রমের পর এল সেই বিশেষ দিন। সকল দিদিমণি দের দীর্ঘ পরিশ্রম, শিক্ষা সব মিলিয়ে আজ ও জানিনা কিভাবে সেই সন্ধ্যায় পুরো শো করেছিলাম এক trance এর মধ্যে। শো শেষ হয়েছে বুঝলাম যখন দেখি আমি স্টেজ এ দাঁড়িয়ে, সামনের পর্দা পড়ে গেছে আর প্রতিমা দি wings এর ধার থেকে দৌড়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলছেন ভীষণ ভালো করেছিস। পরে একদিন ভোরবেলা assembly র পর বড়দি গৌরি দিদিমণি আমার হাতে best actor এর প্রাইজ তুলে দিয়েছিলেন। প্রতিমাদির শিক্ষা আদর ফার্স্ট প্রাইজ সব মিলিয়ে সেই অপরিণত বয়স এই বোধ হয় চেতনা তে নাট্য প্রেম প্রথিত হয়েছিল। সেই প্রেম আজ 60 বছর বয়সেও অটুট। দীর্ঘ দিন পর, তখন আমি মধ্য চল্লিশ, namsaa তখনো জন্ম নেয় নি, auto তে কোথাও যাবার পথে প্রতিমা দির সঙ্গে দেখা। auto র মধ্যেই প্রণাম করে বললাম 'দিদি চিনতে পারছেন?' স্বাভাবিকভাবেই চিনতে পারলেন না। বললাম- দিদি আমি কাবুলিওয়ালা। তারপরেই ফিরে এলো আমার ক্লাস ফাইভ। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন - কত বড় হয়ে গেছিস, ভালো থাকিস। জীবনে কিছু আশীর্বাদ অমূল্য। কিছু মুহুর্ত অবিস্মরণীয়।

শেষ করার আগে দুটো কথা নস লিখলে অন্যায় হবে। পরে NAMSAA র পুনর্মিলন এ অনেকবার দেখা হয়েছে দিদি দের সঙ্গে। প্রতিবার সকলে আমাকে কাবুলিওয়ালা বলেই ডেকেছেন। আমার স্ত্রীর নাম দিয়েছেন কাবুলিওয়ালার বৌ। পঞ্চাশ বছরের বেশি আগে একটি স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান এ একটি নাটকের একটি মাত্র অভিনয় এত সুদূরপ্রসারী impact সৃষ্টি করেছে এমন দ্বিতীয় কোনো উদাহরণ পাওয়া যাবে মনে হয় না।

দ্বিতীয় এবং শেষ কথা। সেই নাটকে মিনি র ভূমিকায় ছিল আমদের দুই বছর junior (তখন সে ক্লাস থ্রী) নিলয়। সে এখন কোথায় জানি না । আমার সহপাঠী অভিজিত চ্যাটার্জি, বিশ্বরূপ পুরকায়স্থ, পার্থ পুরকায়স্থ এরাও সেই নাটকে অভিনয় করেছিল। আমদের সেদিনের বন্ধুত্ত আজ ও অটুট। অভিজিতের সঙ্গে যোগযোগ কম হয়। কিন্তু বিশ্বরূপ, পার্থ ও আমার নাট্য প্রেম একটুও কমে নি। আমরা একসঙ্গে বিভিন্ন গ্রুপ এ অভিনয় করেছি। আজ ও NAMSAA র নাটকেও একসাথে অভিনয় করছি।
তর্পণ সাহা বিজ্ঞান ১৯৭৬ said…
খুব সুন্দর লিখেছিস সুবীর।এই গোধূলি বেলায় যখন একটু ফিরে দেখার অবকাশ হল তখন বুঝতে পারলাম যাদের থেকে শিক্ষা, অনুপ্রেরণা এবং অপার আশীর্বাদ নিয়ে জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলাম, সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে করতে কি করে যেন সেই সমস্ত শিক্ষিকা শিক্ষকদের অবদান বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলাম। কথায় বলে মাতা পিতার ঋণ কখনও শোধ করা যায় না। কিন্তু যেটা বলা হয় না বা খুব কম উল্লেখ করা হয় তা হল একজন প্রকৃত শিক্ষক শিক্ষিকার ঋণও কখনই কোনদিনই শোধ করা যায় না। শ্রদ্ধয়া প্রতিমা পাঁজার মত একজন কিংবদন্তীর স্মৃতিচারণের মাধ্যমে ফিতে কাটার কাজটা তুই শুরু করলি। কোন প্রশংসাই তোর এই অসাধারণ উদ্যোগের জন্য যথেষ্ট নয়। মা সরস্বতীর আশীর্বাদ তোর কলমে সর্বদা বিরাজমান হোক। এইভাবেই আমাদের গুণমুগ্ধ করে রাখিস
ঠিক বলেছেন দাদা।। মাঝে মাঝে মনে হয় যদি আবার ফিরে যাওয়া যেতো সেই দিন গুলোয়, সেই হজমি গুলি, কারেন্ট নুন আর লাল হলুদ আইসক্রীম এর দিন গুলোয় কি মজা ই না হতো।।
ANUPAM MITRA said…
অসাধারণ লিখেছিস সুবীর। তোর লেখনীর ক্ষুরধারতা ফিরিয়ে দিল সেই হারিয়ে যাওয়া ছোটোবেলার দিনগুলি।
Sankar said…
Time hurts...