সুতানুটি ছোটাছুটি
জীবনের
এতোগুলো বছর কেটে গেল এই শহরটাতে । ছোটবেলায় বাবা-মার সাথে দোতালা বাসে বালিগঞ্জ থেকে
টালা পার্ক বা হাওড়া যাবার সময় একটু একটু করে এই শহরটাকে চিনতে শেখা। তখন ধর্মতলার
কাছে ছিল গান্ধীজীর মূর্তি, বাস থেকে সেই মূর্তিটা চোখে পড়লে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাথায়
খেলে যেত একটা লাইন, “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা
চল রে” । কেন যে মনে হতো জানি না, গান্ধী-প্রীতির
পরিবেশে ছিলাম তেমনটা তো না ! কি জানি, মনস্তাত্বিকরা
বলতে পারবেন । এখনও মেয়ো রোডের মোড়ে মূর্তিটা দেখলে মনে পড়ে যায় সেই বাল্য স্মৃতি।
তখন
ক্লাস সেভেন, ১৯৮০, উত্তম কুমার মারা গেছেন সেদিন, দেশপ্রান শাসমল রোডের দুই ধারে মানুষের
ঢল, রাস্তায় গাড়ি নেই, পাতাল রেলের কাজ চলছে তখন, ক্রেনের উপর পর্যন্ত মানুষ বসে আছে।
সেই দেখতে দেখতে নিউ আলিপুর ইস্কুল থেকে প্রায় লেক মার্কেট পর্যন্ত হেঁটে তারপর ট্রামে
করে বালিগঞ্জ হয়ে কসবার বাড়িতে ফেরা ।
সবে
মাধ্যমিক শেষ হয়েছে, লেকের মাঠে লুকিয়ে প্রথম সিগারেটে টান দিলাম। চারমিনার ফিলটার।
বাড়ি ফেরার আগে গন্ধ ঢাকতে চুইংগাম আর পানের বোঁটার একটা মিশ্র স্বাদ আজও মনে আছে ।
এগারো
ক্লাসে থাকতেই লুকিয়ে (তবে স্কুল পালিয়ে নয়) সিনেমা দেখা শুরু হলো।। কখনও আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়ে হেঁটে কখনো বা বন্ধুর
সাথে ভাড়া করা সাইকেলের ক্যারিয়াররে বসে, দক্ষিণ কোলকাতার ওলিতে গলিতে নিরুদ্দেশ ঘুরে
বেড়ানো । কোনোদিন আবার ধর্মতলা থেকে ট্রামে কলেজ স্ট্রিট, শ্যামবাজার, গ্যালিফ স্ট্রিট
পরিক্রমা । এইভাবেই শহরটাকে দেখা, চেনা ।
গ্রাজুয়েট
হলাম, গান গেয়ে বেড়াই এ পাড়া সে পাড়ায়, চাকরীও খুঁজে চলেছি, সেই সাথে নাটক। নিউ এম্পায়ার
এর সেই টঙে বসে ইংরিজি সিনেমা, সেকেন্ড হ্যান্ড বই এর খোঁজে কলেজ স্ট্রিট বা গোল
পার্ক, ওয়েলিংটনে পুরোনো রেকর্ড খোঁজা। হ্যাঁ, অবশ্যই, প্রেমে পড়া এবং প্রেম ভাঙা
।
নব্বই
এর শুরুতে, কোথা থেকে একটা ক্যাসেট পেয়েছিলাম, তাতে বেশ কিছু গান, অন্যরকম বাংলা গান
শুনলাম। সুমন নামের এক শিল্পীর গান। গানের কথা, সুর এমন কি যন্ত্রানুসঙ্গও নাকি তাঁর
নিজের ! কিছুদিনের মধ্যেই বাজারে এলো একটা
ক্যাসেট - "তোমাকে চাই", সুমনের গান। শুরু হোল শোনা। নজরুল মঞ্চে দেখলাম,
স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম প্রথম লাইভ অনুষ্ঠান। “প্রথম স্কুলে যাবার দিন” কিম্বা “গড়িয়াহাটার মোড়” কিম্বা "তিন শতকের শহর" কি ভীষণ প্রাসঙ্গিক
লেগেছিল ।
কোলকাতা,
আমার শহর, আমার জন্ম, আমার “প্রথম সিগারেট”, “প্রথম প্রেম”, প্রথম আরও কতো কিছু। পঞ্চাশ পেড়িয়ে এসে ফিরে তাকালে বুঝি অনেক কিছু বদলে গেছে । বদলে
গেছে কোলকাতা, বদলে গেছে আমার এবং আমার সহনাগরিকদের মানসিকতা। বদলে গেছে সমাজ, সংস্কৃতি,
রাজনীতি, অর্থনীতি আরও না জানি কতকিছু । বড্ড বদলে গেছে বাংলা গান, ভাষায়, সুরে, গায়কীতে,
অনভিপ্রেত ভাবে। আরও বদলাবে কোলকাতা, বদলে যাবো আমি, আমরা, কালের নিয়মে। বাঙ্গালীর
সেই প্রিয় ‘কবি বলিয়াছেন’ - “কাঁপে ছন্দে ভালোমন্দ তালে তালে"
অনেক
নিন্দা শুনি কলকাতার নামে। দোষ কলকাতার নয়, শহরটা শুধু অন্যের দোষের ভাগী। ভালবাসি
কোলকাতাকে। আশা রাখি শেষ দিন পর্যন্ত থাকবো এই শহরেই । ভালো থেকো কোলকাতা ।
“তিন শতকের শহর, তিন শতকের ধাঁধা, এখানে
পড়েছি আমি আষ্টে-পৃষ্টে বাঁধা”
- কবীর সুমন
তিলক
গুপ্ত
মাধ্যমিক
- ১৯৮৪
Comments