কেটটি বা কেটকি
না, শব্দটার সাথে আম ছাত্রসমাজের পরিচয় থাকার কথা নয়, শুধুমাত্র
যে বিশেষ ছাত্রগণ সত্তর, আশি ও নব্বই দশকে নিউআলিপুর বহুমুখী বিদ্যালয়ের দিবা বিভাগে
পড়ার সুযোগ পেয়েছিল, তারাই জানে যে এটি একটি বিশেষ শাস্তিদান পদ্ধতি, যার আবিষ্কর্তা
ছিলেন অঙ্কের প্রথিতযশা শিক্ষক স্বর্গীয় নিশীথ রঞ্জন রায় ওরফে N.R.
ছাত্রের ডান বা বাম হাতের কনিষ্ঠার (দ্বিতীয়বার দিতে হলে
তর্জনী) নখ যেখানে শুরু হচ্ছে, তারপরের নরম অংশের উপর স্যারের বুড়ো আঙ্গুলের নখ চেপে
বসতো। "আহ্ আহ্, স্যার লাগছে" - ছাত্রের কাতরোক্তির সাথে স্যার বলতেন
"মরা, লাগার জন্যই তো দিচ্ছি"। এখনকার সময় হলে হয়তো অভিভাবকরা স্কুল ঘেরাও
করে ফেলতেন।
নিশীথ বাবুর সাথে আমার একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল। স্কুলে তো
ক্লাস ছিলই, তার সাথে প্রাইভেট টিউশনও নিতাম। পরবর্তীকালে স্যার জ্যোতিষ রায় রোডে
বাড়ী কেনেন আমার বাড়ীর কাছেই। প্রায়ই সময়ে অসময়ে আমার বাড়ীতে হানা দিতেন।
প্রথমদিকে টিউশন পড়াতেন পোর্টকলোনীর পিছন দিকে একটা ১০/১০
ঘরে। জনা আষ্টেক ছিলাম আমাদের ব্যাচে। সেইসময় ভাল ছাত্র হিসাবে আমার কিছুটা বদনাম
ছিল। ঘরে ঢুকলেই হুকুম হতো - 'কৌশিক শুরু কর'। যা ভাবছেন, তা নয়; অঙ্ক তো স্যার শুরু
করতেন আমার খাতায়। আমার কাজ ছিল স্যারের পিছনে নীলডাউন হয়ে বসে তাঁর শুকনো একজিমা
ভরা ঘাড় গর্দান টিপে দেওয়া। মাঝে মাঝে চাম্পিও করে দিতে হতো। স্যারের বাম হাতের কাছে
একটা লম্বা ছপটি থাকতো, যা দিয়ে সবচেয়ে দূরে বসা ছাত্রকেও নির্ভুল লক্ষে আঘাত হানতে
পারতেন। একদিন সন্ধ্যায় ক্লাস ছিলো, সেদিন ওনার কিছুতেই আমার ঘাড় টেপা পছন্দ হচ্ছিল
না। কখনো বলছেন - 'মরা, কিছু খাসনি নাকি? এতো আসতে টিপছিস কেন?' আবার চাপ বাড়ালে বলছেন
-'ঢ্যামনা, গরু খাস নাকি?' আমিও রেগে গিয়ে স্যারের মাথার পিছনে বক দেখাচ্ছিলাম। খেয়াল
করিনি আমার মাথার পিছনে লাইট থাকায় ছায়া পড়ছিল স্যারের খাতায়। হঠাৎ করে ছপটিটা পিছনে
ঘুরিয়ে আমায় এক ঘা - "মরা, মাষ্টারকে বক দেখানো?" ক্লাস শেষ হতে সবাই বেড়িয়ে
যাচ্ছি, ডাকলেন - "কৌশিক, শোন, হ্যাঁরে লেগেছে?" বললাম - 'লাগবে না, এতো
জোরে মারলেন।' স্যার বললেন - "তুই ঢ্যামনা, খামোখা আমাকে বক দেখাচ্ছিলি কেন?"
১৯৮৪ সালে জ্যোতিষ রায় রোডের বাড়ীতে পড়াতেন। এখনো চোখে
ভাসে দু'গালে দু'খাবলা দাড়ি, পরনে একটা নীল সিল্কের লুঙ্গি, নেয়াপাতি ভুঁড়ির উপর কোনোরকমে
আটকানো, ডান হাতের তর্জনীতে গুড়াকু। ঐ গুড়াকু দিয়েই আমাদের এক সহপাঠি চপল ঘোষালের খাতায়
লিখে দিয়েছিলেন "চুঃ"। জিজ্ঞাসা করলে বলেছিলেন," চপলের চোদ্দ গুষ্টির
কেউ ঐ অঙ্ক করতে পারবে না, ও নিশ্চয়ই কারুর থেকে টুকেছে।" ওনার কোন ছাত্রের কেমন
মেধা, সে সম্পর্কে স্যারের সম্যক ধারনা ছিল।
আমরা তখন ভাড়া বাড়ীতে থাকি, রাস্তার দিকে জানলার পাশে ঘুমাতাম
আমি, পাশে বাবা। একদিন ভোর রাতে মাথার চুলে প্রবল টান, হাঁউ মাউ করে উঠে বসলাম।চেঁচামেচিতে
বাবাও উঠে পড়েছেন। জানলার বাইরে দেখি স্যার দাঁড়িয়ে, পরনে সেই নীল লুঙ্গি, সাদা ফতুয়া,
আঙ্গুলে গুড়াকু দিয়ে দাঁত মাজছেন; বললেন -'চল কৌশিক, আমার বাড়ী, অঙ্ক করবি।' বললাম-
'স্যার, আমার ৭টায় ক্লাস, এখন তো সাড়ে চারটে সবে।' স্যার বললেন - " চল না, মড়া,
তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙ্গে গেছে আমার, কি করবো, চল তোকে অঙ্ক করাই।" এমনই ছিলেন স্যার।
নিশীথ বাবুর ছেলে দৈবকী রায় ক্লাস সিক্স থেকে আমাদের সহপাঠি
ছিল - এখবর অনেকেই জানেন না। নিশীথ বাবু কে নিয়ে আমার স্মৃতিতে অনেক ঘটনাই আছে, তার
সবটা লেখার মতো নয়। আর একটা ছোট ঘটনা লিখে শেষ করবো। সালটা মনে নেই, বার্ষিক পরীক্ষা
চলছে। আমার সিট পড়েছে দোতলায় এখন যেটা ১২নং ঘর, তাতে। পরীক্ষা শেষ হতে মিনিট ১৫ বাকি,
লেখা শেষ, খাতায় সুতো বাঁধাও শেষ। মনটা খচ্ খচ্ করছে, দু'একটা ছোট ছোট জায়গা মেরামতির
প্রয়োজন মনে হচ্ছে। হঠাৎ দেখলাম আমার এক প্রিয় বন্ধু সহপাঠি দাঁত বার করে বাথরুমের
দিকে চলেছে। গার্ড ছিলেন নিশীথ বাবু স্যার।
উঠে দাঁড়িয়ে বললাম -"স্যার, বাথরুম যাবো।" স্যার বললেন -"না, শেষ
হলে যাবি।" "স্যার, খুব জোর পেয়েছে।" "উঠে আয়" - ভাবলাম
মার খেতে হবে। ভয়ে ভয়ে গেলাম। দুটো সাদা সুতো হাতে দিলেন। বললাম-"স্যার, খাতা
বাঁধা হয়ে গেছে।" স্যার বললেন "এ'দুটো ডগায় বেঁধে বসে থাক।"
স্যার যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন, প্রণাম।
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
মাধ্যমিক ১৯৮৫
Standing (L-R) Ranen Babu (RND), Ashim Babu (AB), Ajay Babu (AKM), Nishith Babu (NR), Sisir Babu (SM), Bibhuti Babu (BG), Dipak Da (Clerk), Mihir Babu (MG).
Seated (L-R) Barun Babu (BKC), Dipak Babu (DKG), Hiranmay Babu, Paresh Babu (PD), Lakshmi Babu (LKD).
Comments
একটা কথা মনে পড়ে গেলো - নিশীথ বাবু ডাকলেই আমাদের বাদশা বড়াল দুই হাতের দশ আঙ্গুল মুখে ঢুকিয়ে নিতো । আর সেই লালা-সিক্ত আঙ্গুল দেখে নিশীথ বাবু আরও রেগে গিয়ে ডাস্টার ছুঁড়ে মারবার উপক্রম করতেন।
সুমিত রায়