আমার শিক্ষক, আমার বাবা
আমার
শিক্ষক, আমার বাবা
নারায়ণ
চন্দ্র গুপ্ত ও সরলা সুন্দরী দেবীর কনিষ্ঠ সন্তান বিভুতিনাথের জন্ম ২১ আগস্ট ১৯২৫,
অবিভক্ত ভারতের ফরিদপুর জেলার কুড়াশী গ্রামে । পালং হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক তারপর
কোলকাতায় এসে বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক । ১৯৪৬ এ আবার গ্রামে ফিরে গিয়ে পালং হাই
স্কুলেই শিক্ষকতা শুরু । বাবা বলতেন এবং বিশ্বাস করতেন "Once a teacher
always a teacher."
দেশভাগের
কিছু পরে পাকাপাকি ভাবে কোলকাতায় চলে আসা । সাক্ষী ছিলেন মন্বন্তরের, দেশভাগের । কোলকাতায়
এসে প্রধানত ছাত্র পড়ানো তারপর কোলকাতা পুরসভায় অস্থায়ী একটি চাকরী, সেই সময় চারুচন্দ্র
কলেজ থেকে বাংলা ভাষায় স্পেশাল অনার্স পাশ করে টালিগঞ্জে আদর্শ বিদ্যামন্দিরে শিক্ষকতার
দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হোল । ১৯৬৪ সালে শুরু হয় নিউ আলিপুর বহুমুখী বিদ্যালয়, সেই স্কুলের
প্রথম দিন থেকে তিনি ছিলেন, সেখান থেকেই অবসর ১৯৯০ সালে।
গ্রামে
থাকতেই মার্গ সঙ্গীতের তালিম, প্রখ্যাত হীরেন্দ্র গাঙ্গুলীর (হীরু বাবু) এক অখ্যাত
ছাত্রের কাছে । কোলকাতায় এসে জ্যোতিরীন্দ্র মৈত্রর সান্নিধ্য, সেই সাথে শচীন দেব, হিমাংশু
দত্ত, ভীষ্মদেব, তারাপদ চক্রবর্তী, জ্ঞান গোস্বামী ও তৎকালীন শিল্পীদের গান শোনা ।
বাবার খুব ইচ্ছে ছিল ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে গান শেখার, কথাবার্তাও হয়ে গেছে,
এমন সময় হঠাৎ করেই ভীষ্মদেব নিরুদ্দেশ হলেন, বাবার সেই ইচ্ছে অপূর্ণই থেকে গেল । তারপর,
রেডিও, গ্রামোফোন আর স্বারলিপি সম্বল করে নিজেই শেখা । ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্পর্কে
ছিল গভীর জ্ঞান, আর তাঁর সাথে প্রবল ভালবাসা রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি, পাশাপাশি নজরুল,
অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তর গানেও বাবা ছিলেন অনায়াস সাবলীল ।
বেশ
একটু অর্থোডক্স মনে হতো বাবাকে, নির্বিচারে সব শিল্পীর গান, বা সব ধরনের গান বাবাকে
শুনতে দেখিনি । আমার উপরেও বেশ নিষেধাজ্ঞা ছিল গান শোনার বিষয়ে । রবীন্দ্রসঙ্গীতে পঙ্কজ
মল্লিক, সুবিনয় রায়, প্রসাদ সেন, সুচিত্রা - কনিকা - নিলিমা আর আধুনিক গানে শচীনদেব,
অখিলবন্ধু, সতীনাথ, সুধীরলাল, প্রতিমা, এটাই ছিল আমার সিলেবাস। বিদ্রোহ করে দেখেছি,
কোনও ফল হয়নি । তবে, ক্ল্যাসিকালের ক্ষেত্রে কোনও নিষেধ ছিল না । বেশ বড় হবার পর যখন
নানা রকম গান শোনা, গাওয়া শুরু করলাম, এমন কি ইংরেজি গান, তখন অবশ্য কোনও বাধা পাই
নি । জানতে চেয়েছিলাম কেন ওই বাধা ছিল ছোটবেলায়, বাবা বলেছিলেন, ভালো গান শোনার কান
তৈরি করার দরকার ছিল, কোনটা ভালো, কেন ভাল আর নয় এই বোধটা তৈরি হবার দরকার ছিল, তাই
বাধা ছিল ।
আমার
বাবা ছিলেন রবীন্দ্র সাহিত্য ও সঙ্গীতের একনিষ্ঠ অনুরাগী । কলেজ জীবনে সামিল হয়েছিলেন
কবির অন্তিম যাত্রায়, যদিও কোনোদিন শান্তিনিকেতনে তাঁর যাওয়া হয়ে ওঠেনি । আমিও নিউ
আলিপুর বহুমুখী বিদ্যালয়ের ছাত্র, বাবা, আমার শিক্ষক ক্লাসে মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন
করতেন – “ বলতো, কি আছে রবীন্দ্রনাথে ?” তারপর একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে নিজেই
তার উত্তর দিতেন – “ কি নেই !”
আমাদের
বাড়িতে বই একটা বিশেষ জায়গা পেত, আমার বা মায়ের বা বাবার জন্মদিনে, বাবা-মার বিবাহবার্ষিকীতে,
পুজার সময়, নববর্ষে আর কিছু হোক বা না হোক একটা বই কেনা হতো । পরে টেপ রেকর্ডার আর
রেকর্ড প্লেয়ার আসার পর তাঁর সাথে একটা ক্যাসেট বা রেকর্ড ।
ছোটবেলায়
আমার কমিক্স পড়ার অনুমতি ছিলনা, বাবা বলতেন “যদি ছবিতেই গল্প দেখা হয়ে যায় তাহলে তুমি নিজে কল্পনা
করবে কি করে ? আম আঁটির ভেঁপুর কি কমিক্স বানানো যায় ? ওই সব আজগুবি অরন্যদেব না পড়ে
ভালো বই পড় ।“ স্কুলে যখন বিজন বিজন ভট্টাচার্য্যর
নবান্ন পড়াতেন, তখন মন্বন্তরের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে যেন পৌঁছে যেতাম সেই সময়ে ।
শুধু নবান্ন কেন, যে কোনও “পিস” পড়াবার সময় সেই একই অনুভূতি, পাঠ্য বইটা হাতেই থাকতো,
আর গল্পে গল্পে পড়া হয়ে যেতো । বাবার ক্লাসের একটা ছদ্মনাম ছিল, “গল্প দাদুর আসর” । আমাদের স্কুলের ছাত্র, আমারই এক অনুজ
প্রতিম , ওঙ্কার, একবার বলেছিল, যখন পড়তাম তখন বুঝিনি সেই ভাবে, কিন্তু এখন মনে হয়
বিভূতি বাবু ছিলেন “google” ।
আমার
ছোটবেলায় বাবার কাছে বসে বাবার ছোটবেলার গল্প শুনতাম, বাতাবি লেবু দিয়ে যে কি করে ফুটবল
খেলা যায় সেই ভেবে অবাক হতাম । অবশ্য ছাত্র জীবনে, শিক্ষক-দিবসের ছাত্র-শিক্ষক ম্যাচে
বাবাকে সত্যিকারের ফুটবলে পেনাল্টি শটে গোল (!) করতে দেখেছি ।
অনেকে
বলে “my father is my hero”, কিন্তু আমার বাবাকে কখনো “হিরো” মনে হয়নি, তিনি ছাপিয়ে গেছেন । আমার বাবা আমার দেখা
একজন বিস্ময়কর মানুষ । ভীষণ অর্থোডক্স অথচ একজন খোলা মনের মানুষ । নিতান্ত সাধারন অথচ
অসাধারন ।
তিলক গুপ্ত
১৯৮৪ মাধ্যমিক
Video Clip. NAMSAA felicitated Sri. Bibhuti Nath Gupta.
Comments
বিভূতি বাবু আমার স্কুল জীবনের শুধু একজন বাঙ্গলা ভাষার শিক্ষকই তো ছিলেন না। উনি ছিলেন একজন রূপকার যিনি অকথিত, অসামান্য দক্ষতায় সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং মাতৃভাষার প্রতি মমতা, ভালবাসার এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে আমার অবচেতনকে প্রোগ্রাম করে দিয়েছিলেন। অবশ্যই এই উপলব্ধি পরিণত জীবনের। ইস্কুলবেলায় মনে হত বিভূতি স্যার এত কড়া না হলে কি এমন ক্ষতি হত ওনার !!?? কোন এক অজ্ঞাত কারণে বরাবরই ওনার স্নেহধন্য থাকার সৌভাগ্য প্রাপ্তি হয়েছিল। কিন্তু তার জন্য কড়া অনুশাসনের ক্ষেত্রে কোনরকম ছাড় ছিল না। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে ওনার সাথে! অষ্টম শ্রেনীতে সাহিত্য বিভাগে ভাল নম্বর (সেই যুগের মূল্যায়নে।এখনকার ছাত্র ছাত্রীরা সেই ভালত্বের পরিমান শুনে হয়ত হেসে খুন হয়ে যাবে) পাওয়া সত্ত্বেও আমার বিজ্ঞানকে পরবর্তী অধ্যয়নের বিষয় নির্বাচন করা জনিত স্যারের হতাশা, বন্ধুদের উদ্দেশ্যে অশালীন শব্দ প্রয়োগ করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পরা এবং দশম শ্রেনীতে ধূমপান করতে গিয়ে ধরা পরে যাওয়ার পর ওনার ক্রোধান্বিত রুদ্র মূর্তি......কত কত আরও কত শত স্মৃতি।
নিখীল বিশ্বের যেখানেই থাকুন খুব ভাল থাকুন স্যার। আপনাদের মত শিক্ষক ছিলেন বলেই বোধহয় আমার মত অকিঞ্চিৎকর ছাত্র বিশ্বাস করতে পেরেছিল “আমিও পারব”
সশ্রদ্ধ প্রণাম রইল ❤️❤️❤️☺️🙏🏼🙏🏼🙏🏼
(@ তর্পণ সাহা বিজ্ঞান ১৯৭৬)
তারপর আবার দীর্ঘদিন পর নামসার প্রথম সভায় স্যার কে দেখলাম।। প্রনাম করলাম। নামসার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্যার উপস্থিত থাকতেন।।
তারপর চিরঅবসর নিলেন।। স্তব্ধ হলেন "গল্প দাদু"।।
যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।।
প্রনাম।।
সুবীর ব্যানার্জী।। ১৯৯০ মাধ্যমিক।।
Pronam....
Supriyo 1986 Madhyamik
আমাদের সময় BG sir, extra curriculum class এর সময় যারা সংগীত নিয়েছিল তাঁদের গান ও শেখাতেন।
সত্যম দাশগুপ্ত, ১৯৭৬, মাধ্যমিক