সে এক সাংঘাতিক স্মৃতি বটে!
আমরা তখন বোধহয় ক্লাস নাইনে পড়ি - টেনও হতে পারে। তখন কলেজের মাঠে খেলোয়াড় বলতে শুধু আমরাই। কলেজের ছাত্রছাত্রীরা আমাদের এই উপদ্রব খুব একটা পছন্দ করতো না - কিন্তু আমাদের নেতা - দোর্দন্ডপ্রতাপ শ্রীমান গনশার কল্যানে সে সব নিয়ে কেউ খুব একটা ট্যাঁ-ফোঁ করতো পারতো না। এমনকি কলেজের ইউনিয়ন রুমের টি টি বোর্ডটাও আমাদের ছেলেদের দখলেই থাকতো - যতদিন পর্যন্ত না আমাদের চার তলার লাইব্রেরি ঘরে নিজেদের বোর্ড বসেছিলো - কিন্তু সে অন্য গল্প!
যাক গে - এখন সেই ঐতিহাসিক খেলার কথায় আসি। সেদিন আমরা কলেজের সামনের মাঠে খেলছি - আর পাশের ছোট্টো অংশে কিছু কলেজের বালক বালিকা (যাদের আমরা নিতান্ত দয়া করে তাদের নিজেদের মাঠে বসতে দিয়েছিলাম) আড্ডা মারছিলো। গোল বাঁধলো গোল নিয়ে - মানে গোলপোস্ট নিয়ে। সেদিন পোস্টের সাথে বাঁধা ছিলো একটা বেশ স্বাস্থ্যবান গরু। খেলার মাঠে গবাদি পশুর সাথে সহাবস্থানের অভ্যাস থাকায় প্রথমে কেউই এটা নিয়ে বিচলিত হই নি। বিশেষ করে আমি তো এই নিশ্চিন্তে জাবর কাটা প্রানীটিকে নিয়ে খুবই স্বস্তিতে ছিলাম - আমি গোলকিপার, ইনি অর্ধেক গোল আগলে রেখে আমার কাজ কমিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বিধি বাম। মিনিট পনেরো খেলা গড়িয়েছে, এমন সময় গনশার এক জোরালো শট আমার প্রবল চেষ্টা ব্যর্থ করে গোলে ঢুকতেই যাবে - কিন্তু গরুমশাই তাতে বাদ সাধলেন! ব্যস! আর যায় কোথায়!
"এক গোলে দুটো গরু থাকলে খেলা যায় না" বলে গনেশ তেড়ে এলো! আমাকে গরু বলার প্রতিবাদ করবো, না গরুকে গোলকিপার বলার - এটা বোঝার আগেই গনেশ সোজা এসে গরুর দড়ি দিলো খুলে! ওর ইচ্ছে বোধহয় ছিলো গরুটাকে গোলের থেকে দুরে কোথাও বেঁধে আসবে - কিন্তু একটু আগে গোলার মতো শট অনিচ্ছায় আটকে গোমাতা নিতান্তই রুষ্ট হয়েছিলেন - তার উপর আবার দড়ি নিয়ে টানাটানি! তিনি মারলেন ছুট! দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে তিনি ছুটলেন। গনেশও ছাড়ার পাত্র নয় - সে দড়ি ধরে ঝুলে পড়লো। গনেশের দুঃসাহস আর গায়ের জোরের কথে সে সময়ে স্কুলে ছাত্র-শিক্ষকের মুখে মুখে ঘুরতো বটে - কিন্তু তার পক্ষেও উন্মত্ত ভীত গোমাতাকে বশে আনা সম্ভব হয় নি। যতদুর মনে পড়ে, গনেশের সাথে আমরা বেশ কয়েকজন দড়ি ধরে ঝুলে পড়েছিলাম, কিন্তু তাতে খুব একটা তফাত হয় নি! গরুতে-মানুষে এই অসম দড়ি টানাটানির খেলায় ফল যা হবার তাই হলো - কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পাশে কলেজের ছাত্রছাত্রীদের আড্ডাবৃত্তের মধ্যে গরুর প্রবেশ - পেছন পেছন দড়ির সাথে ঝুলতে থাকা কিছু অর্বাচীন! তারপরের মর্মান্তিক দৃশ্যের বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় - তবে মিনিট কয়েক পর সেই গরুর গেট দিয়ে তীরবেগে প্রস্থান পর্যন্ত যে মিনি আম্ফান বয়ে গিয়েছিলো সেটা আমি পাঠকের কল্পনার উপর ছেড়ে দিচ্ছি। তবে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে সেই গরু যখন রঙ্গমঞ্চ হইতে প্রস্থান করিল, তখনও একা গনশা তার দড়ির সাথে লেগে ছিলো বটে!
এরপর প্রায় হপ্তা দুয়েক আমরা কলেজের মাঠমুখো হই নি - সেটা বলাই বাহুল্য!
আনন্দ দাসগুপ্ত
মাধ্যমিক – ১৯৮৫
Comments